আসাদের পতন : সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কী?

 সিরিয়ায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলা আসাদ পরিবারের শাসনের পতন হয় অনেকটা আচমকাই। কয়েকদিনের ব্যবধানে চোখের সামনেই ধসে পড়ে বাশার আল আসাদের সাম্রাজ্য। সপরিবারে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন বলে দেশটির গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।



সপ্তাহখানেক আগেও আসাদের পতন অনেকটা অকল্পনীয়ই ছিল।

দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সমন্বিত হামলায় সপ্তাহের ব্যবধানে তা এখন বাস্তব। আসাদ পরবর্তী সিরিয়ার কী হবে তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর দাবার ছকে পরিণত হওয়া সিরিয়ায় নিজেদের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিতের চেষ্টা করছে দেশগুলো। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্ন সামনে আসছে তা হলো— আসাদ পরবর্তী সিরিয়ার সরকার কে, কীভাবে গঠন করবে; সিরিয়ার এই নাটকীয় পরিবর্তন বিশ্ব মোড়লরা কীভাবে দেখছে?  

সিরিয়ার সরকার, নিরাপত্তা এবং ভঙ্গুর অর্থনীতির ভবিষ্যতের বিষয়ে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের পরিচালক সানাম ওয়াকিলের মতে, দ্রুত পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে  মসৃণ রূপান্তর খুবই কঠিন।আচমকা এই পরিবর্তন সিরিয়ান নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় দায়বদ্ধতা এবং সুশাসন নিশ্চিতে ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে।  

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বিশ্লেষক লাহিব হিগেল বলেন, মুহূর্তটি সিরিয়ানদের জন্য উদযাপনের, সেটা আজ তাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তবে চিন্তার বিষয় আগামীতে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে? 

বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যেটি দেখার বিষয় তা হলো— কত দ্রুত বিদ্রোহীরা রাজধানীসহ সারাদেশে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে এবং আসাদের পতনে ক্ষমতার যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ করতে পারে। একইসঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো জোটবদ্ধ থাকে কিনা সেটাও দেখার বিষয়।

এটিও পরিষ্কার নয় যে কীভাবে একটি নতুন সরকার সিরিয়ায় অঞ্চল দখলকারী বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ রক্ষা করবে। এমনকি নতুন সরকার মৌলিক নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে পারবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়। 

লাহিব হিগেল এই পরিস্থিতিকে সাদ্দাম হোসেনের পতন পরবর্তী ইরাকের সঙ্গে তুলনা করছেন। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরের আশা জাগলেও দ্রুতই তা ক্ষীণ হয়ে যায়। দেশটি চলে যায় একটি নৃশংস সাম্প্রদায়িক গৃহযুদ্ধের দিকে।

উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আসাদের পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের। গোষ্ঠীটির নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির সরকার পরিচালনা করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। কট্টরপন্থী সুন্নি ইসলামপন্থী মতাদর্শের আল-জোলানি তার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি সহনশীলতা দেখিয়েছেন। বিষয়টি ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলেও পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন লাহিব হিগেল। 


বাশার-আল আসাদের পতনে এই অঞ্চলের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি পালাবদল হবে সেটা বলাই বাহুল্য। আসাদের এই পতনে খুশি হবে ইসরায়েল ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাধ্যমে ওই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বড় ধাক্কা খেয়েছে— বলছেন বিশ্লেষকরা। আসাদ ইরান এবং হিজবুল্লাহর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। কারণ, তার শাসনামলে সিরিয়াকে ব্যবহার করে হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠিয়েছে তেহরান। 

সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে হিজবুল্লাহ। ইরানসমর্থিত আরেক সশস্ত্র-গোষ্ঠী ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা একাধিকবার বিমান হামলার কবলে পড়েছে। এ ছাড়া ইরাকের মিলিশিয়া, গাজার হামাস, যাদের ইরান ‘প্রতিরোধের মেরুদণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করত, তারা সবাই ইতোমধ্যে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়ার মনোযোগ দিতে পারেনি সিরিয়ার প্রতি। আর এতেই নাটকীয় পতন হয় আসাদের। 

তবে তুরস্কের আশীর্বাদ ছাড়া সিরিয়ায় আসাদের পতন ঘটতো না বলে মনে করেন অনেকে। যদিও বিদ্রোহীদের সমর্থনের কথা অস্বীকার করেছে আঙ্কারা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান অবশ্য আসাদের পতন চেয়েছিলেন। কারণ, গৃহযুদ্ধের কারণে ৩০ লাখ সিরিয় তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন। যারা দেশটির অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলছিলেন। বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে আসাদকে অসংখ্যবার অনুরোধ করেছিলেন এরদোয়ান।  

দীর্ঘ ২৯ বছর সিরিয়া শাসনের পর ২০০০ সালে বাবা হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন বাশার আল আসাদ। সেই সময় তাকে তরুণ সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে দেখা হয়েছিল সিরিয়ার জনগণের আশাভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। ক্ষমতায় আসার পর বাশার দ্রুতই তার পিতার শাসন কাঠামোকে আরো কঠোর করে তোলেন। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য তিনি সমালোচিত হন।

২০১১ সালের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে সহিংসতার মাধ্যমে দমন করেছিলেন আসাদ। এই বিক্ষোভের পর দেশটিতে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। প্রাণ হারান ৫ লাখের বেশি মানুষ। বাস্ত্যচ্যুত হন আরও ৬ লাখ। রাশিয়ার আকাশশক্তি, ইরানের সামরিক কমান্ডারদের পরামর্শ আর লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সহায়তায় প্রথমবার বিদ্রোহীদের থামাতে সমর্থ হন আসাদ। এরপর থেকে ইরান-রাশিয়ার সমর্থনে বিদ্রোহীদের কঠোর হাতে দমন করে আসছিলেন আসাদ।

সূত্র : দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ও বিবিসি।

Post a Comment

Previous Post Next Post